সেলাই মেশিন চালিয়ে ছেলেকে দেশসেরা বিসিএস ক্যাডার বানালেন মা
অভাবের সংসার ছিল তারাপদ সরকারের। মাছের ব্যবসা করতেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ কিনে ‘বিক্রি করতেন হাটবাজারে। সেই মাছ ‘বিক্রির রোজগারের টাকা দিয়ে চলতো সংসার ও ছে’লে-মে’য়ের লেখাপড়া।
২০০৬ সালে হঠাৎ দুর্যোগ নেমে আসে তার পরিবারে। সাতক্ষীরার ত্রিশমাইল এলাকায় সড়ক দু’র্ঘ’টনায় মা’রা যান তারাপদ সরকার। এতে বেসামাল হয়ে পড়ে তার পারিবার। ছে’লে-মে’য়ের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়ে যায়।বাবা মা’রা যাওয়ার পর ভা’রাক্রা’ন্ত মন নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন ছে’লে লালটু সরকার। সেলাই মেশিন চালিয়ে ছে’লেকে লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন মা।
পাশাপাশি টিউশনি করেছেন লালটু। সেদিনের লালটু সরকার ৩৮তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে সারা দেশের মধ্যে তৃতীয় হয়েছেন।লালটু সরকার সাতক্ষীরার তালা সদরের মাঝিয়াড়া গ্রামের বাসি’ন্দা। ভাই-বোনের মধ্যে লালটু ছোট। বড় বোন দিপালী সরকার থাকেন স্বামীর বাড়িতে। মা সুলতা সরকার থাকেন গ্রামের বাবার রেখে যাওয়া কুঁড়েঘরে।মঙ্গলবার (৩০ জুন) ৩৮তম বিসিএসের ফল প্রকাশ হয়েছে।
ফলাফলে লালটু সরকার সারা দেশের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন। বুধবার (০১ জুলাই) সন্ধ্যায় জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপ হয় লালটু সকার ও তার মা দিপালী সরকারের। এ সময় অ’সহায় হয়ে পড়া দিনগু’লোর কথা বলে আবেগাপ্লুত হন মা-ছে’লে।দিপালী সরকার বলেন, ২০০৬ সালে লালটুর বাবার মা’রা যাওয়ার পর খুব অ’সহায় হয়ে পড়েছিলাম।
দিন চলতো না ঠিকমতো। খেয়ে না খেয়ে থেকেছি। এরপর একটি বেসরকারি সংস্থা একটা সেলাই মেশিন দেয়। সেই সেলাই মেশিনের হাতের কাজ করে উপার্জনেরটাকা দিয়ে সংসার চালতো। ছে’লে লেখাপড়া শিখতো। খুব বেশি খরচ ছে’লেকে কোনোদিন দিতে পারিনি। তবে চে’ষ্টা করেছি সাধ্যমতো। ছে’লে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। তবে এটি কি জিনিস আমি বুঝি না। তবে ছে’লে বলেছে ভালো চাকরি পেয়েছে। আমা’দের আর অভাব থাকবে না। খুব খুশি হয়েছি। ছে’লের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
লালটু সরকার ২০০৭ সালে তালা বিদে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মান’বিক বিভাগে জিপিএ-৪ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০০৯ সালে তালা শ’হীদ মুক্তিযো’দ্ধা মহাবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪.৬০ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০১৩ সালে অনার্স ও ২০১৪ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
অ’সহায়ত্বের দিনগু’লোর কথা তুলে ধরে লালটু সরকার বলেন, এসএসসি পরীক্ষার এক বছর আগে বাবা মা’রা যান। বাবা মা’রা যাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তবে লেখাপড়া চালিয়ে গেছি। অভাবের মধ্যেই বেড়ে উঠেছি।এইচএসসি শেষ করে তালা থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর টাকার অভাবে চারটি টিউশনি করেছি। সেই টাকায় শেষ করেছি লেখাপড়া। মা-বোন সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছে আমাকে। মা-ই আমা’র একমাত্র সম্বল।
লালটু সরকার বলেন, মাস্টার্স শেষ করার পর বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। বার বার ব্য’র্থ হয়েছি। তবে আমি স্বপ্ন দেখতাম বিসিএস ক্যাডার হব। ২০১৭ সালে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। পরীক্ষা দিয়েই বুঝেছিলাম আমা’র নাম আসবে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। এরপর দৈনিক ১৮-১৯ ঘণ্টা পড়ালেখা করতাম। অবশেষে শিক্ষা ক্যাডারে সারা দেশে তৃতীয় হয়েছি। আমা’র স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়ার পর অনুভূ’ত ি জানিয়ে লালটু সরকার বলেন, পরিশ্রম করলে সব সম্ভব। আমি চে’ষ্টা করেই আজ সফল হয়েছি। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় আমি খুব খুশি। এখন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আমা’র ওপর আসা রা’ষ্ট্রেরসরকারি দায়িত্ব পালন করতে চাই। সেজন্য সবার কাছে দোয়া চাই। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার আগে বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) পদে সুপারিশপ্রা’প্ত হয়েছি। এছাড়া বর্তমানে ফরিদপুরের সদরপুর মহিলা কলেজের প্রশাসন হিসেবে দায়িত্বে রয়েছি।
স্থানীয় বাসি’ন্দা তালা সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এসএম নজরুল ইস’লাম বলেন, পরিবারটি খুব অ’সহায়। মা খুব ক’’ষ্ট করে ছে’লেটিকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। লালটু নিজেও অনেক ক’’ষ্ট ও পরিশ্রম করে আজ বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। এলাকার সুনাম বয়ে এনেছেন। তার এমন ফলাফলে এলাকার মানুষ আনন্দিত।